খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র কে হবেন-তা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। তবে ভোটকেন্দ্রে ‘ভোটার উপস্থিতি’র হার নিয়েই বেশি সক্রিয় উভয় দলের নেতারা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনকে নিজেদের মতো করে ‘মডেল’ হিসাবে উপস্থাপন করতে চান তারা। মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের জয়ের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। তবুও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায়, কম-বেশি ৫০ শতাংশ ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দিতে আসুক। একইসঙ্গে নির্বাচনে দৃশ্যমান সহিংসতা না হোক। কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের জয় নিশ্চিত করতে যাতে সহিংসতায় জড়িয়ে না পড়েন সেই পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় প্রশাসনকেও দলটির পক্ষ থেকে ‘বার্তা’ দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে ভোটকেন্দ্রে না যান সেজন্য দলের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। আজ ভোটের দিন দলটির কারা ভোট দিতে যাচ্ছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করবে গোপন মনিটরিং কমিটি। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এ ভোট নিয়ে মানুষের ‘অনীহা’ রয়েছে-সেটা ইস্যু তৈরি করতে চায় দলটি। বড় দুদলের এমন অবস্থানে অস্বস্তিতে জাতীয় পার্টি। দলীয় প্রার্থীর সম্মানজনক ভোট চান নেতারা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
খুলনা সিটি করপোরেশনে আজ ভোট। ইসি ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য যাই থাকুক না কেন তারা নিজেদের দায়িত্ব থেকেই সুষ্ঠু ভোট করতে চান। ভোটে অনিয়ম ঠেকাতে ২৮৯টি কেন্দ্রেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় নয় হাজার সদস্য মাঠে রয়েছেন। এছাড়া ৩১ম জন নির্বাহী ও ১০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছেন।
খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পাঁচজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন-আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক, জাতীয় পার্টির মো. শফিকুল ইসলাম মধু, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আব্দুল আউয়াল, জাকের পার্টির এসএম সাব্বির হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম শফিকুর রহমান। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। দলটির ৯ নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় তাদের ‘মীরজাফর’ আখ্যায়িত করে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় আরও ১১ জনকে শোকজ করা হয়েছে। অপরদিকে জামায়াতের পাঁচজন কাউন্সিলর পদে ভোট করলেও তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।
এ সিটিতে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। ১৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। তারা দুজনই আওয়ামী লীগের নেতা। এ নির্বাচনে ভোটার রয়েছেন পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন ও মহিলা ভোটার ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন।
সরেজমিন খুলনা সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কে সড়কে ঝুলছে প্রার্থীদের পোস্টার। অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রাণচাঞ্চল্য রয়েছে। এদিন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক নগরীর হাদিস পার্কসংলগ্ন দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নেন। সেখানে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানান। অপরদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম মধুও দলীয় কার্যালয়ে যান। তিনিও সংবাদ সম্মেলনে নিজের পক্ষে ভোট চান। প্রার্থীদের কর্মতৎপরতা থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ভোট নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই। তাদের মতে, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় মেয়র পদে তালুকদার আব্দুল খালেকের নাম ঘোষণা শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
নগরীর কেডি ঘোষ রোডের সোনাপট্টির ফল ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, আগেরবার নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছিলাম। তখন আমাকে বলা হয় আমার ভোট নাকি দেওয়া হয়ে গেছে। এবার ভোট দিতে যাব কিনা তা বলতে পারছি না। টুটপাড়ার বাসিন্দা আইয়ুব আলী বলেন, মেয়র কে হচ্ছেন তা ভোটের আগেই আমরা জানি। তাই এ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কম। তবে অনেকদিন ভোট দেওয়ার সুযোগ পাই না। তাই এবার ভোট দিতে যাব।
ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল : স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং সেই ভোটে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়-খুলনা থেকে এমন বার্তা দিতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। সেই লক্ষ্য নিয়ে এ নির্বাচনে যাতে বিতর্ক তৈরি না হয় সেজন্য প্রচারণা থেকে ভোট পর্যন্ত পরিবেশ শান্ত রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভোট পর্যন্ত সেই পরিবেশ বজায় রাখতে স্থানীয় নেতাকর্র্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, এ নির্বাচনে বিএনপির সাবেক সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু অংশ নেবেন এমনটিই ধারণা ছিল। দলীয় পদ হারানোর বঞ্চনা থেকেই তার নির্বাচনে লড়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচন থেকে তিনি সরে যাওয়ায় নতুন কৌশল নিতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। তখন থেকে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে-এমন ধারণা থেকে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেয়নি। কাউকে জোর করে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি। এ কারণে বেশিরভাগ ওয়ার্ডে ৬-১০ জন পর্যন্ত কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রায় সব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। এর বাইরে ৯টিতে বিএনপি বহিষ্কৃত ও ৫টিতে জামায়াত নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের প্রচারেও বাধা দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, এসব কাউন্সিলর প্রার্থী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসবেন। এ নির্বাচনে কম-বেশি ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি আশা করছেন নেতারা। এছাড়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে যাতে সহিংসতা না হয়, সেজন্য স্থানীয় নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনকেও কঠোর থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশলের বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জ মনে করছি। নেতাকর্মীদের বলেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের বিনয়ের সঙ্গে কেন্দ্রে নিয়ে আসবেন এবং নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানাবেন।
বিএনপির কৌশল : স্থানীয় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ নির্বাচনকে ইস্যু হিসাবে দেখাতে চায় বিএনপি। দলীয় সরকারের অধীনে মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী নয়-সেটাই প্রমাণ করতে চান দলটির নেতারা। তারা মনে করছেন, তাদের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে না গেলে এ নির্বাচনে ২৫-৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে না। এজন্য আজ ভোটকেন্দ্রে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোট দিতে যান কিনা-তা মনিটরিংয়ের জন্য ৩১টি ওয়ার্ডে গোপন কমিটি করা হয়েছে। প্রতি কমিটিতে ২১ জন সদস্য রয়েছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের যারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন তাদের ভিডিও, ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করবেন ওই সদস্যরা। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্ট থেকে কারা কারা ভোট দিতে গেছেন তাদের তালিকা ও নাম সংগ্রহ করবে বিএনপি।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ৫ জুন চিঠি দিয়ে নেতাকর্মীদের ভোট দিতে কেন্দ্রে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন বিএনপি নেতাদের সতর্কভাবে চলাচল করতে বলা হয়েছে। তারা জানান, খুলনা বিএনপি-জামায়াতের ভোটব্যাংক হিসাবে পরিচিত। বিএনপি নেতা শেখ তৈয়বুর রহমান খুলনা সিটি করপোরেশনের দুবার নির্বাচিত ও একবার মনোনীত মেয়র ছিলেন। মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান মনিও একবার মনোনীত ও একবার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। সিটি করপোরেশন এলাকার সংসদ-সদস্যও বিএনপি থেকে বারবার নির্বাচিত হয়েছেন। এ হিসাবে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির খুলনা মহানগর আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, যত কমসংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন, রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ততই লাভবান হবে। কারণ এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হয় না। তাহলে মানুষের ভোট দিয়ে লাভ কী-এটাই নেতাকর্মীদের বোঝানো হয়েছে। তারা ভোটকেন্দ্রে যেন না যান সেজন্য বলা হয়েছে।