নিজস্ব প্রতিবেদক:
একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে ‘জনশূন্য বইমেলা’ দুপুর গড়াতেই রূপ নিয়েছে ‘জনসমুদ্রে’। হাজারো মানুষ এলেন- আড্ডা-গল্প, আলোচনা, গান, কবিতায় প্রাণ পেল মেলার আঙিনা।
সকালে লোক সমাগম না হওয়ায় প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট যারা হতাশ হয়েছিলেন, সন্ধ্যায় তাদের মুখেই দেখা গেল খুশির ঝিলিক।
প্রতি বছরের মতই এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকাল ৭টায় দ্বার খোলা হয় বইমেলার। তবে মেলা জমে উঠতে শুরু করে মূলত দুপুরের পর থেকে।
সন্ধ্যায় মানুষের ভিড় জনসমুদ্রে রূপ নেয়, এতে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানোই কঠিন হয়ে পড়ে।
ঝুমঝুমি প্রকাশনীর বিক্রয় ব্যবস্থাপক রিফা তামান্না ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি সকাল ৭টা ২০ মিনিটে স্টলে এসেছি, কোনো লোকজন নেই। একদম ফাঁকা।
“তবে ১০টার পর থেকে কিছু লোকজন আসা শুরু হয়। আর বিকালে ও সন্ধ্যায় উপচেপড়া ভিড় হয়েছে। লোক না থাকলে মেলা কেমন জানি প্রাণহীন লাগে। বিকেল থেকে অনেক লোক এসেছে।”
সকালে বিক্রি না হলেও বিকালের পর থেকে বই বিক্রি সন্তোষজনক, বলেন তিনি।
শিশুদের বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দোলন এর প্রকাশক কামাল মুস্তাফা সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, লোক সমাগম না থাকায় বিক্রি হতাশাজনক। তবে বিকালে তার স্টলেও বিক্রি বেড়েছে।
অন্যপ্রকাশ, বাতিঘর, ইউপিএল, ঐতিহ্য, কথাপ্রকাশ, আগামী, তাম্রলিপি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় লোক সমাগমের পাশাপাশি বই বিক্রিও ভালো হয়েছে।
তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ভিনদেশিদের আগমন কম বলে মনে করেন কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি অনেকে আসেন বাংলাদেশে। তারা শহীদ মিনার এবং বইমেলায় ঘুরে বেড়ান। এবার তেমন কাউকে চোখে পড়েনি।”
একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাভাষী ভিনদেশি অনেক কবি-সাহিত্যিকও আসেন, যাদের এবার দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন অপু মেহেদী।
বিকালে মেলায় অতিরিক্ত লোক সমাগম সামলাতে পুলিশকে তৎপর দেখা যায়নি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে হকারদের মেলায় ঢুকে পড়ার দৃশ্যও দেখা যায়।
মেলা প্রাঙ্গণেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে চলছে ‘একুশে নাট্য উৎসব’। এই উৎসবেও প্রচুর লোক সমাগম হয়েছে।
বইমেলার জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, মেলার ২১তম দিনে নতুন বই এসেছে ৩০৭টি।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুক্রবার অমর একুশে বইমেলার স্টল ঘুরে বই কিনছেন দর্শনার্থীরা।
শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি রাত সাড় ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে শুক্রবারের কর্মসূচি শুরু করে।
সকাল ৮টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে দেড় শতাধিক কবি কবিতা পাঠ করেন বলে তথ্য দিয়েছে বাংলা একাডেমি।
সেখানে সভাপতিত্ব করেন কবি হাসান হাফিজ।
এদিন ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি মোহন রায়হান ও কবি আবিদ আজম।
ভাষার লড়াই অভ্যুত্থানের শক্তি: আনু মুহাম্মদ
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৫। এই অনুষ্ঠানে ‘ভাষার লড়াই, গণঅভ্যুত্থান ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
প্রাবন্ধিক আনু মুহাম্মদ বলেন, “ভাষা আন্দোলনের প্রেরণাই ছিল পরবর্তী ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের শক্তি।”
“১৯৪৮ সালে শুরু হয়ে মাতৃভাষার অধিকার এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল।”
ন্যায়সংগত, বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাঙ্খা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা আজ প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে পারি মাতৃভাষার অধিকার এবং নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান নিয়ে।”
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্যের উৎস নিমূর্ল করতে হবে বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “সত্যিকারভাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রহসর হতে গেলে পরিবর্তনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।”
মূল মঞ্চে অনুষ্ঠানের সূচনায় স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, “একুশের চেতনা আমাদের মাঝে এক প্রাত্যহিক বর্তমানময়তা হয়ে সতেজ রূপে বহমান আছে। একুশ অতীত নয়, এটি প্রকৃতপক্ষেই বর্তমান।”
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুক্রবার অমর একুশে বইমেলার স্টল ঘুরে বই কিনছেন দর্শনার্থীরা।
“বাংলাদেশের ইতিহাসে বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, এর পরবর্তী ন্যায্যতা ও পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপট-এই তিন ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তাই সংগত কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষকে অন্তরঙ্গতায় এবং আবেগময়তায় সিক্ত করে।”
সভাপতির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, “ইতিহাস কেবল অতীতের বিষয়ই নয়। এটি পরিবর্তনের রহস্য উদ্ঘাটনের বিদ্যা। জাতীয় সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদেরকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হতে হবে। এর মাধ্যমেই আমরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য অগ্রসর হতে পারব।”
গান ও কবিতা
সন্ধ্যায় মেলার মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক পর্বে কবিতা পাঠ করেন রুম্মানা জান্নাত, নিলয় রফিক ও কাজিম রেজা।
সংগীত পরিবেশন করেন শাহিন পারভীন, অধরা সরকার রিয়া, এ কে এম সাইদ হোসেন, তাহরিমা বতুল রিভা, লায়েকা বশীর, বিটু কুমার শীল, শেখ জেরিন শবনম, সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা, শ্রাবণী পাইক, আরিফা নিশাত, বিভাস রঞ্জন মৈত্র, প্রেমা দাস।
যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন শিমুল বড়ুয়া (তবলা), রাজিব আহমেদ (কি-বোর্ড), মো. মেজবাহ উদ্দিন (অক্টোপ্যাড), সাইদ হাসান ফারুকী (লিড গিটার) এবং পল্লব দাস (বেইজ গিটার)।
শনিবার যা থাকছে
শনিবার বইমেলার ২২তম দিন। মেলা শুরু হবে সকল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর।
বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে হবে ‘জীবন ও কর্ম: কায়কোবাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইমরান কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হাবিব আর রহমান। সভাপতিত্ব করবেন আবু দায়েন।