জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া সব উদ্যোগ এক ধরনের রহস্যের জালে আবৃত হয়ে পড়েছে। যে কারণে দলটি নিষিদ্ধ করতে আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি আট বছর ধরে আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। অপর দিকে নিবন্ধন বাতিলের আপিল শুনানিও নয় বছরে হয়নি। এমনটিই মনে করছেন আইনসংশ্লিষ্টরা। কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সরকার এ দুটি বিষয়ে সিরিয়াস হলে অনেক আগেই সেটেল করা সম্ভব ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা করা হয়নি। হয়তো এটাও এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল।
সূত্র জানায়, সন্ত্রাসী দল হিসাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে সরকার ২০১৫ সালে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত আইন না থাকায় মামলা দায়ের ও বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ওই সময় একটি খসড়াও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা এতদিনেও মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হয়নি।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রোববার বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি পড়ে আছে। আসলে তারা (সরকার) এ আইন সংশোধন করবে বলে মনে হয় না।
এটা রাজনীতি, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। এটা সরকারের কৌশল বলতে পারেন। তিনি বলেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া তাদের (সরকারের) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এটা তো তারা বলেছেন। যেহেতু নিবন্ধন পেন্ডিং রয়েছে সেহেতু বলা যাবে না, নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। রাজনৈতিক দল ছাড়াও সভা সমাবেশ করতে পারবে।
এদিকে ১০ বছর পর শনিবার জামায়াতে ইসলামীকে সরকার প্রকাশ্যে জনসভা করার অনুমতি দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এখন নানা রকম আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে জামায়াতের এই নতুন অবস্থানকে সরকারের সঙ্গে গোপন আতাত বলেও মন্তব্য করছেন। তবে সরকারের তরফ থেকে এখন বলা হচ্ছে তারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার অবস্থান থেকে পিছু হটে আসেনি। শিগগির এ সংক্রান্ত আইনটির সংশোধন প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। রোববার বিষয়টি বাংলার মুখ বিডি ২৪কে নিশ্চিত করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত রোববার বাংলার মুখ বিডি ২৪কে বলেন, ‘আপিল বিভাগ যুদ্ধাপরাধের অনেকগুলো রায়ে সন্ত্রাসী দল হিসাবে জামায়াতের বিচার এবং জামায়াতকে সন্ত্রাসী দল ঘোষণা করার পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা একটি প্রতিবেদনও ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মামলা করার চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় ছিলাম। এমতাবস্থায় অদৃশ্য নির্দেশে সেটি থেমে যায়।’ প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দল হিসাবে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল দেন।
শুনানির অপেক্ষায় নিবন্ধন বাতিলের আপিল : উল্লিখিত রুলে রাজনৈতিক দল হিসাবে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) এবং ৯০সি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধানপরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না কেন, তা জানতে চাওয়া হয়। জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল, দলের তৎকালীন আমির, নির্বাচন কমিশনসহ চার বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায় দেন। এরপর রায় স্থগিত চেয়ে জামায়াত আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে, যা ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট খারিজ হয়।
এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। দলটির নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০এইচ ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হলো।
এরপর রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই আপিল করে দলটি। আদালতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানিয়া আমীর। শুনানিতে সময়ের কথা উল্লেখ করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন তুহিন।
আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিক রোববার বাংলার মুখ বিডি ২৪কে জানান, গত ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত করতে (সারসংক্ষেপসহ ফাইল) চূড়ান্তভাবে দুই মাস সময় দেন আপিল বিভাগ। আমরা মার্চের মধ্যেই আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিয়েছি। এখন যেদিনই মামলাটি তালিকায় আসবে সেদিনই শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমীর গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মামলাটির আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আপিলটি শুনানির জন্য অনেকবার উদ্যোগ নিয়েছি। আদালত তাদের (জামায়াতের আইনজীবী) অনেকবার সময় দিয়েছেন। গত ৩১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ দুই মাসের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপসহ ফাইল শুনানির জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন।