1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : News Editor : News Editor
রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৬:২০ অপরাহ্ন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির লজ্জাজনক চিত্র

সম্পাদকীয়
  • আপডেট সময় : রবিবার, ১৮ জুন, ২০২৩
  • ৪৩ বার সংবাদ দেখেছেন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির লজ্জাজনক চিত্র
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির লজ্জাজনক চিত্র

সীমাহীন সেশনজট, শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম সুবিধা না থাকা আর শিক্ষক নিয়োগের অনিয়মে যখন দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ধুঁকছে; তখন বাংলার মুখ বিডি ২৪এ প্রকাশিত একটি সংবাদ পড়ে শিউরে উঠতে হয়। ওই সংবাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ২০টির মতো অনিয়ম চিহ্নিত করার তথ্য রয়েছে। বিশেষত নিয়োগে দুর্নীতির পাশাপাশি আর্থিক অনিয়মের যেসব তথ্য ওই সংবাদে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তা দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের দিক নির্দেশ করে।

একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিলাসবহুল বাংলো থাকার পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাড়ি ভাড়া ভাতা গ্রহণের মতো গর্হিত কাজ করে যাচ্ছেন অবলীলায়। বিষয়টিকে বিধিবহির্ভূত চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জন্যই চরম অপমান ও লজ্জার।

সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করেছে। প্রায় ১২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার এ বাজেট অনুমোদনের পাশাপাশি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ লুটপাটের প্রায় ২০ খাতের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। এ তথ্যগুলোকে আমলে নিলে তা নিঃসন্দেহে দেশের নতুন প্রজন্মের বিকাশের জন্য একটি অশনিসংকেত হিসাবে ধরা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা ইউজিসির জনৈক সদস্য ওই সংবাদে বাংলার মুখ বিডি ২৪কে জানিয়েছেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব খাতে আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে, তা বহুদিন ধরে চলছে। স্বায়ত্তশাসন থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ম তৈরি করতে পারে। এরই অপব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না যে আইনে কেবল অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, আর্থিক নয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে দেশের আইনকানুনের মধ্যে থেকেই আর্থিক প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে।’ এ ধরনের নিয়মের উল্লেখ থাকলেও তা প্রতিপালনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। ফলে প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে ইউজিসিকেও কাগুজে বাঘ হয়ে থাকতে হয়েছে।

তবে ইউজিসির আরেক সদস্য কিছুটা আশারবাণীও প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রকম দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেসব যাতে আর না হয়, তা সামনে রেখে পরিপত্র তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দু-তিনদিনের মধ্যে কমিশনের বৈঠকে পাশ হওয়া সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেয়ে যাবে।’ সব থেকে বড় বিষয় এ সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা আর সেটি যেহেতু ইউজিসি করতে পেরেছে, এখন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ধীরে ধীরে চিহ্নিত অনিয়মগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় সংকটগুলো থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত ভূমিকা রেখেছেন। সামাজিক পরিসরে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিঃসন্দেহে অনেক সম্মানের আসনে আসীন। কিন্তু এ ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি একাধারে তাদের মর্যাদা যেমন ক্ষুণ্ন করছে, তেমনই এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে জাতিকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যাদের পেয়েছিলাম, তারা প্রত্যেকেই শুধু আমাদের নন, পুরো জাতির কাছে ছিলেন সম্মানের পাত্র। নিজেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত থেকে বুঝতে পারি সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ আমাদের কোন স্থানে রেখেছেন। তাই দৈনিক পত্রিকার পাতাজুড়ে যখন এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ পায়, তখন অসহায় অবস্থায় আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ইউজিসি চিহ্নিত বিধিবহির্ভূত আর্থিক সুবিধা নেওয়া ২০টি খাত বলতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা দেশের উচ্চশিক্ষাকে এক অর্থে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। বিধিবহির্ভূতভাবে পঞ্চম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তাকে তৃতীয় গ্রেড প্রদান কিংবা অনিয়ম করে পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান, যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতি, অননুমোদিত পদে নিয়োগ, আপগ্রেডেশন ও বেতন প্রদানের অনিয়ম এক অর্থে কল্পনার বাইরে। অন্যদিকে অনেককে তাদের অনর্জিত ইনক্রিমেন্ট প্রদান করতে গিয়ে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। এগুলো শিক্ষক হিসাবে ব্যক্তিবিশেষের কতটুকু মানহানি করছে তা তারাই বলতে পারবেন, তবে এতে করে পুরো শিক্ষক সমাজের সম্মান যে একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

নজিরবিহীনভাবে অনেকে বেতনের বাইরে নানা নামে উপাচার্য হিসাবে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ করেই থেমে থাকেননি; তারা বাংলোতে বসবাস করা সত্ত্বেও বাড়ি ভাড়া গ্রহণ করছেন। অন্যদিকে পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পরও কম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্গফুটের হিসাবে ভাড়া গ্রহণ করছেন। শুধু তাই-ই নয়, মফস্বলের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-জনবলকে দেওয়া হচ্ছে সিটি করপোরেশনের হিসাবে বাড়ি ভাড়া। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে।

ইউজিসির ওই প্রতিবেদনে সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে সেশন বেনিফিট প্রদান, পিআরএলের পরিবর্তে এলপিআর প্রদান, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল ভর্তুকি দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে তাদের জন্য গবেষণা, মোবাইল-টেলিফোন-ইন্টারনেট ভাতা অবধি গ্রহণ করছেন। কেউ কেউ লাজলজ্জার মাথা খেয়ে নিয়মের বাইরে বই-ভাতা গ্রহণ করছেন। অনেকে তাদের ড্রাইভারদের দিচ্ছেন নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডের বেতন। সব মিলে প্রতিটি আর্থিক অনিয়ম দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে একটা লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিয়েছে।

গবেষণা কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যয় হয়নি; তবু বেড়ে গেছে তাদের বরাদ্দ। আর এক্ষেত্রে বিদ্যমান অনিয়ম রুখতে চিহ্নিত ২০ খাতের অর্থ লুটপাট বন্ধের বিকল্প নেই। ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ অনিয়ম বন্ধ করতে যে ৫৫টি নির্দেশনা দিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারলেও তার প্রয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিশেষত ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির দায় যখন পুরো প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়, তখনো বেশির ভাগ মানুষ নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর ফলেই দিনের পর দিন সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজরা।

দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচলিত বিধি মেনে ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী হালনাগাদ করে নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে পারে। অন্যদিকে অনাগত নতুন বছরের প্রাথমিক বাজেটও আগে থেকে প্রেরণ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামীর ব্যয়ের প্রাক্কলন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের মূল উৎস প্রথমবর্ষের ভর্তির ফরম বিক্রি ও শিক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত সেশন ফি। এ দুটি খাতে আয়কৃত অর্থের উপযুক্ত ব্যয় ও যথাযথ হিসাব নিশ্চিত করা জরুরি। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী ‘প্রথমবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে, বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে।’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এ আইন মেনে কাজ করে এবং উদ্দিষ্ট আয়কে নিজস্ব আয় হিসাবে প্রদর্শন করে, তাহলে তা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পথ অনেকটাই পরিষ্কার করবে।

প্রথমবর্ষের ভর্তি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের থেকে নানাবিধ টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি, ল্যাব টেস্ট-কস্ট এবং বিশেষ কোর্স ফি আদায় করে। এর বাইরে তারা নিজস্ব সম্পত্তি থেকেও আয় করে। এ আয়গুলোর উপযুক্ত হিসাব দেখানো হলে দুর্নীতি কমে আসতে পারে নানা দিক থেকে। গবেষণাসহ নানা কারণে অগ্রিম অর্থ উত্তোলনের প্রচলন রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। নানা কারণে অগ্রিম হিসাবে উত্তোলিত অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে দুর্নীতি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুনির্দিষ্ট খাতের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করাও অন্যায়ের হাত লম্বা করে। মূল খাতের অর্থ অভ্যন্তরীণ নানা খাতে দেখিয়ে ফাইল সমন্বয় করার শুভংকরের ফাঁকি বেশ প্রচলিত। নিয়ম মেনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতির বাইরে নানা খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ হলে আর্থিক অনিয়ম নিঃসন্দেহে কমবে।

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, তাদের পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রতা হ্রাস, তথ্য জানার অধিকার এবং তাদের জন্য বরাদ্দ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। এতে করে বিধিবহির্ভূত খাতে ব্যয়ের অসুস্থ প্রবণতা কমবে। শ্রেণিকক্ষের হতশ্রী দশা, ভাঙা চেয়ার ও বেঞ্চ, ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়া, শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচ্ছন্ন প্রাক্কলন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকার বিপরীতে অনেক উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যয় করে তাদের বাংলো বাড়িকে রাজপ্রাসাদের রূপ দিয়েছেন। পাশাপাশি উপাচার্যের নেক নজরে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও বাগিয়ে নিয়েছেন নানা অনৈতিক সুবিধা। এগুলো প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেমন রুগ্ণ করে দিয়েছে, তেমনই ধ্বংস করেছে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ। তাই সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নির্ধারিত বিধি মেনে আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ও অবকাঠামো খাতে যে ভঙ্গুর দশা, তা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ সম্ভব।

সামাজিক যোগাযোগ এ শেয়ার করুন

একই বিভাগের আরও সংবাদ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত © ২০২১ বাংলার মুখ বিডি
ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট @ ইজি আইটি সল্যুশন